ভূতো কবিগণ
মানুষের মতো ভূতেদের মধ্যেও ইদানিং কবি প্রতিভার উন্মেষ গঠেছে। তারাও রচনা করছে বিখ্যাত সব ছড়া-কবিতা। আর দেদারমে চলছে তাদের সাহিত্য আসরগুলো। বাঁশাগা কিংবা বটের আগায় বসে সভা-সমাবেশ। হাজার হাজার কাব্যপ্রেমী ভূত সেখানে হাজির হয়। আর বইমেলাগুলো তো পাঠকের আগমনে জমজমাট। এত ভূত আসে যে চলাচলই দায় হয়ে যায়। তাই কর্তৃপক্ষ ভূতদের বইয়ের প্রতি অনুৎসায়িত করেও বইমেলায় তাদের আগমন কমাতে পারেনি। লেখকরাও অবশ্য এত বই পাগল ভূত পছন্দ করে না। তাদের অটোগ্রাফ দিতে সমস্যা হয়ে যায়। অনেক লেখক আবার অটোগ্রাফ বিক্রিও করে। এতে তাদের ভালই ইনকাম হয়।
ভূতেদের মধ্যে কবিতা লিখে যারা বিখ্যাত হয়েছে তাদের মধ্যে ভূতোখুরি, কবি
খেকচরি, কবি সুরসুরি, কবি ভুগচুরি, কবি গড়গড়ি, কবি মাথা পাগলসহ আরো অনেকে।
খেকচরি বিখ্যাত হয়েছে তার ‘ভূতেশ্বরী’ নামক কাব্য- গ্রন্থের জন্য। ভূতোখুরি
হলো গ্রামের কবি, অনেকটা কবি জসীম উদ্দীনের মতো। গ্রামে বাঁশগাছের সরু
আগায় বসে সারাদিন শুধু কবিতা লেখে। ভূতেদের বিজ্ঞানী হরস্কোপের মত সেও মাঝে
মাঝে খাওয়া-দাওয়া ভুলে যায়। সে সবার কাছে “বাঁশগার কবি” নামে পরিচিত।
নিজেকে নিয়ে একটা কবিতার জন্য সে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দুই হাজার
লাইন বিশিষ্ট এ কবিতার চারটি লাইন তোমাদের জন্য দেওয়া হলোঃ
“বাঁশ আগায় বসিয়া লিখিতেছি কাব্য
আমি কবি ভূতোখুরি, সৃজি কবিতায় নাব্য
আমার কবিতাগুলো বাঁশাগায় থাকবে না পড়ে
আমি হব বিখ্যাত অর হয়ে মরে।”
ভূতেদের
কবিতা লেখার প্রধান সুবিধা হল তারা সাধু-চলিত ভাষা এক সাথে মিলালেও তাদের
গুরুচন্ডালী দোষ হয় না। ভুতো পন্ডিতগন মনে করে যে যেভাবে ইচ্ছা লিখতেই
পারে। সকলে বুঝতে পারে এমন জিনিসই তারা ব্যবহার কওে, নিয়ম টিয়মের ধার ধারে
না। বর্তমানে ভূতো সমাজে কবিদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে কবি ভুগচুরি।
সে বিখ্যাত হয়েছে তার উল্টা-পাল্টা লেখা নিয়ে প্রকাশিত ‘ভালবাসার ভূতক্ষণ’।
এ গ্রন্থে সাহিত্যের কিছুনেই বলে অন্যান্য ভূতোকবিরা তাকে কবি উপাধি দিতে
নারাজ। কিন্তু বর্তমান ভূত সমাজে তরুনদের উল্টা-পাল্টা জিনিস পছন্দ হওয়ায়
তার বইটি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। তাই উপাধি সে এমনিতেই পেয়ে যায়।
ব্যাঙের
ছাতার মতো ভূতো-সমাজে এখানে সেখানে গড়ে উঠেছে নানা পত্রিকার অফিস। তবে
সরকার কর্তৃক অনুমোদিত দেশের একটি মাত্র প্রধান পত্রিকা রয়েছে। ভূতো-সমাজে
এই পত্রিকার এতই কদর যে, পাঁচ হাজার কোটি সার্কুলেশন হয়েও অনেকে কিনার মত
পত্রিকাই পায় না। পত্রিকার নাম হলো ‘ভূতোংলাপ’। সাপ্তাহিক এক লক্ষ পৃষ্ঠায়
প্রকাশিত। দেশ-বিদেশ সবখানে এই পত্রিকার কদর আছে। বহু টাকায় রপ্তানী হয় এই
পত্রিকা। বর্তমানে সরকারের আয়ের একটা বড় অংশ হলো এই পত্রিকা। এতে সব কবিরা
পৃষ্ঠা দখলের চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। একবার কবি খেকচরির লেখা এ পত্রিকায়
প্রকাশিত না হওয়ায় চারদিকে তুল-কালাম কান্ড চলে। রাজনৈতিক নেতাদের মতো
খেকচরির ভক্তরা পত্রিকা অফিস ঘেরাও গাছপালা ভাঙ্গা ও আগুন জ্বালানোসহ নানা
কর্মসূচি পালন করে। তাই এ পত্রিকার সম্পাদক পেলসককিকে সব সময় সাবধান থাকতে
হয় যেন দুর্নীতিবাজ লেখদের লেখা যাতে বাদ না পড়ে। তাদের লেখা ছাপানো
আবশ্যক, পরে ভাল লেখকদের লেখা-অবশ্য যদি পৃষ্ঠা বাকি থাকে।
সবচেয়
বড় কবিতা লিখে যে বিখ্যাত হয়েছে তার নাম হলো কবি গড়গড়ি। সে পাঁচলক্ষ
লাইনের একটা কবিতা লিখে সবার টপে আছে। তারপরে চারলক্ষ নিরানব্বই লাইন
বিশিষ্ট একটা কবিতা লিখে দ্বিতীয়তে আছে ভূতোখুরি। কবি গড়গড়ি কবিতা লেখতে
শুরু করলে আর যেন শেষ হতে চায় না। তার সবচে কম লাইনের কবিতাটাও দুই লক্ষ
তিন লাইন বিশিষ্ট। তাছাড়া ভুতোকবি গড়গড়ি তার এত্তসব বড় বড় কবিতার জন্য
অর্জন করেছে ভূতেদের সবচে সেরা পুরষ্কার “ভূতোষ্কার-১০০.৭”।
ভূতোকবিরা
যে শান্তিতে ছিল তা কিন্তু নয়। তাদের মধ্যে চলত সব সময় প্রতিযোগিতা। কে
কাকে কিভাবে পেছনে ফেলবে তা নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকত। এই যেমন কবি হতে হলে
চুল বড় হওয়া চাই-ই-চাই। কিন্তু কার চুল কত বড় তাই ছিল দেখার বিষয়। ভূতেদের
মধ্যে সবচে বড় চুল ছিল কবি মাথাপাগলের। কিন্তু তাকে পেছনে ফেলার জন্য
খেকচরি মাথাপাগলের চুল থেকে আরো দুই হাত লম্বা আলগা চুল লাগায়।
কারো
জনপ্রিয়তা যদি বেড়ে যেত তাহলে ভূতোকবিদের অনেকে কিছু ভূতকে টাকা খাইয়ে আনত
তাদের নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখানোর জন্য। এই ছিল ভূতোকবিদের মধ্যকার দ্বন্দ।
ভূতসমাজে
বিভিন্ন এলাকায় কবি হওয়ার জন্যও আবার কোঠাপ্রথা চালু ছিল। যেমনটা আছে
আমাদের সমাজে। দেশে কবির সংখ্যা কাকের মত বেড়ে যাওয়ায় ভূতো সরকারকে এ
ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। তাই বাদ পড়তে হয়েছে অনেক নবীন কবিকে [সাবধান, এ রচনা
যেন কোনভাবেই ‘ভূতোসংলাপ’ পত্রিকার সম্পাদ পেলসককির হাতে না যায়। তাহলেই
কম্ম সাবাড়। লিখতে হবে তার পত্রিকায়। আমার পক্ষে আবার দুই-তিন হাজার লাইনের
কবিতা লেখা অসম্ভব। তাই পাঠকদের গোপনে পড়ার অনুমতিক্রমে লেখক।]