Friday, September 16, 2011

প্রেম নিবারণ কমিটি

এলাকার ভিতরে মুহিদ ভাই বেশ সাংগঠনিক লোক হিসেবে পরিচিত। যে কোন মুহূর্তে যে কোন সংগঠন দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারেন। তাই ওনার সাথে আমাদের সখ্যতাটা ও বেশ। কারন ওনার সংগঠনের প্রথম সারির সদস্য হিসেবে তো আমরাই থাকি। নতুন কোন সংগঠন চালু করলেই প্রথমে ডাক পড়ে আমাদের।
মুহিদ ভাই এ পর্যন্ত দশের উপর সংগঠন তৈরি করেছিলেন। কিন্তু একটাও বেশিদিন টিকেনি। ‘চোর ধরা কমিটি’ তৈরি করে তো একবার পুরো গণ-ধোলাই খেতে হয়েছিল। তারপর ও ওনার সংগঠন প্রীতি কমেনি।
সেদিন তিনি বালুকে দিয়ে আমায় খবর পাঠালেন নতুন সংগঠনের কথা বলে। কি আর করব এলাকার বড় ভাই বলে কথা, যেতে তো হবেই।
নতুন সংগঠনটা বেশ জোরালো ভাবেই শুরু করেছেন বলে মনে হলো। সংগঠনের প্রথম সভায় আমার মতো এলাকার অনেক ছেলেই যোগ দিয়েছে। নতুন সংগঠনের কাজ কি এখনো তা কারো কাছে খোলাস নয়। সভায় এসেই মুহিদ ভাই শুরু করল, “বুঝলিরে বাবলু, ইদানিং ছেলেদের ভিতর ভাইরাসের মত যেভাবে প্রেম সংক্রমন হচ্ছে এলাকার অবস্থা খারাপ হতে আর বেশি দিন নেই। ছেলে পেলে সব পড়ালেখা বাদ দিয়ে প্রেম-পত্র লেখায় ব্যস্ত। আর বাপের পকেট চুরি তো অহরহ ঘটছেই। মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় এ প্রেমের কারণেই ঘটছে। তা বন্ধ করা না গেলে ছেলেগুলো সব বখে যাবে।”
মুহিদ ভাইয়ের কথা শুনে দেখলাম নুজুর মুখটা বেশ শুকিয়ে গেছে। বেচারা সদ্য মন আদান প্রদানে ব্যস্ত। গোগলটাকে ও দেখলাম বেশ চুপসে যেতে।
তারপর তিনি আবার শুরু করলেন, “তোরা তো এলাকার কোন খবর রাখিস না। তাহলে বুঝতি প্রেমের ভাইরাস ছেলেদের কিভাবে সংক্রমন করছে। মাঝির বার বছরের ছেলেটা ওপাড়ার সখিনাকে নিয়ে পালিয়ে, ব্যাপারটা ভাবতে পারিস তোরা। তাছাড়া ইদানিং বাবলুর ছোট ভাইটাকে ও মেয়েদের পেছনে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়।”
এ কথা শুনে আমার বেশ রাগ চেপে গেল। তাই দাঁড়িয়ে বললাম, “এ কী বলছেন মুহিদ ভাই। যে আমি জীবনে কখনো মেয়েদের দিকে তাকাইনি। আর আমার ভাই!! না, বিশ্বাস হয় না।”
এবার মুহিদ ভাই বেশ মুড নিয়ে বললেন, “বিশ্বাস হবে কেমন করে, আমার ও তো প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। আর এ কারণেই তো আজ তোদের ডাকলাম। আমরা একটা নতুন কমিটি গঠন করব যার নাম হবে ‘প্রেম নিবারণ কমিটি’ এ কমিটির কাজ হবে এলাকার ছেলেদের মন থেকে প্রেমের ভাইরাস দূর করা। আর যত প্রেম কাহিনী চলছে সবগুলোর সমাপ্তি টানা “
সবাই মিলে ভেবে দেখলাম ব্যাপারটা আসলে খারপ না। বেশ জনকল্যানমূলক কাজ হবে। তাছাড়া এলাকার ভাল ছেলেদের তালিকায় আসার এটা একটা বড় সুযোগ। ব্যাপারটা নিয়ে তাই আমরা সবাই বেশ উৎসাহী হয়ে পড়লাম। আর এরই মধ্যে আমরা পুরোদমে কাজও শুরু করে দিলাম। মুহিদ ভাইয়ের কথামতো, আমরা সবাই মিলে প্রেম বিরোধী স্লোগান দিয়ে বেশ কিছু প্ল্যাকার্ড, পোষ্টার তৈরি করলাম। তাতে লেখা ছিল প্রেমকে ঘৃনা কর প্রেমিককে নয়,প্রেম করার ছেয়ে মুরগি পালা ভাল। আর প্ল্যাকার্ড, পোষ্টার নিচে বেশ বড় করে লেখা ছিল প্রচারে ‘প্রেম নিবারণ কমিটি’।
আমাদের তৈরি এই প্ল্যাকার্ড আর পোষ্টারগুলো বেশ কাজে লাগল। কিছু কিছু ছেলে মেয়ে এই পোষ্টারগুলো দেখেই লজ্জায় প্রেম করা ছেড়ে দিল। তাছাড়া এলাকার মুরুব্বিরা এই প্রেম বিরোধী সংগঠনের বেশ প্রসংশা করতে লাগলেন।
বেশ কিছুদিনের ভিতর এই প্রেম নিবারন কমিটির জয় জয়কার পড়ে গেল। আর মুহিদ ভাই তো ভাবে একেবারে ভাবুক। কেউ সংগঠনের প্রসংশা করলে তিনি মুগ্ধ হয়ে তা শ্রবন করেন তারপর সংগঠনের সুদূর প্রসারী কিছু কাজের কথা শুনিয়ে দেন। যা শুনে লোকে বাহ্্! বাহ্! করে।
পাড়ায় কুখ্যাত প্রেমবাজ হিসেবে রকি খুবই সুপরিচিত। ওকে দিনের বেলায় গার্লস স্কুলের সামনে ছাড়া খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। সুন্দর কোন মেয়ে দেখলেই তার পিছে ঘুর ঘুর করে। ও যে এখন পর্যন্ত কত মেয়ের সাথে প্রেম করেছে তার সঠিক হিসাব ওর নিজের কাছে ও অজ্ঞাত। ওর মত কুখ্যাত প্রেমিককে কি করে ঠিক করা যায় সেটাই আমাদের প্রেম নিবারণ কমিটির পরবর্তী মিশন। ওকে যে এ থেকে দূরে রাখা সোজা নয় সেটা আমাদের সবারই জানা ছিল কিন্তু অসাধ্যকে সাধন করাই তো মানবের কাজ। তাই আমরা চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।
সেদিন দুপুরে রকির সাথে আমার হঠাৎ দেখা। একটা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমার দিকেই আসল। তারপর সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষতে পিষতে আমায় বলল, “শুনলাম তোরা নাকি প্রেম বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিস। ওসব না করে, বাসায় গিয়ে পিটার খা সেটা আরো ভাল হবে।” কথাটা শুনে আমার বেশ রাগ হল। কিন্তু তবু ও নিজেকে শান্ত রেখে ওকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। প্রেমের অপকারিতা নিয়ে দীর্ঘ একটা বক্তব্য ও দিয়ে দিলাম। কিন্তু সবই মনে হয় বৃথা হল। সে আমায় থামিয়ে দিয়ে বলল, “তোর মত চ্যাচকা প্রেমের কি বুঝিস রে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ,জীবনানন্দ, কাজী নজরুল ইসলাম সবই তো প্রেমের গীত গেয়েছেন। শেক্সসপীয়ারের মত মানুষ লিখেছেন রোমিও জুলিয়েট। আহ্! প্রেম কি মধুর সেটা বুঝার বয়স কি তোদের হয়েছে। যত্তসব বুজরুকির দল।” তারপর যেই প্রেম স্বর্গ হতে এসে, জীবনে অমর হয়ে রয় এই গানটা গাইতে গাইতে চলে গেল।
রকির অপমানটা আমার বেশ গায়ে লেগে রইল। তবে কবি সাহিত্যিকদের উপর বেশ রাগ হল। সবাই তো প্রেম নিয়ে ইচ্ছামত কবিতা গল্প লিখেছেন। কিন্তু প্রেম বিরোধী একটা কবিতা ও খঁজে পাওয়া যায় না, যা ছেলেদের শুনানো যেত। তাই নিজেই প্রেম বিরোধী কবিতা লেখা শুরু করলাম। আর সেগুলো রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের নামে চালিয়ে সবাইকে পড়ে শুনাতে লাগলাম। রকির প্রেম নিবারন করার ভাল একটা আইডিয়া ও পেয়ে গেলাম মুহিদ ভাইয়ের কাছে। মুহিদ ভাই মানুষটা যে জিনিয়াস বুঝাই যায়।
পরিকল্পনা মত প্রথমে রকির বর্তমান প্রেমিকাকে খঁজে বের করা হল। তারপর তার কাছে ইচ্ছামত রকি সর্ম্পকে প্যাচ লাগানো হল। ফলে দেখা গেল দু দিনের ভিতর রকি চ্যাকা খেল। ছেলেটা দমবার পাত্র নয়, কিছু দিনের ভিতর নতুন একটা জুটিয়ে ফেলল। আমরা ও আশা দমবার নই, আগের পরিকল্পনাটাকেই কাজে লাগালাম। শেষ পর্যন্ত আমরাই সফল হলাম। বার বার চ্যাকা খেয়ে রকি প্রেমের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ল। সেদিন আমাদের সভায় যে নিজেই এসে হাজির হল। প্রেম নিবারন কমিটিতে নিজের নাম লিখিয়ে বলল, “বুঝলি বাবলু প্রেম-টেম ওসব ভুয়া। জীবনে কোন কাজে লাগে না। এসব থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভাল।” রকির মত প্রেমবাজ ছেলেকে যেহেতু আমরা ঠিক করতে পেরেছি সুতরাং বলা যায় আমরা সফল। এমন একটা সফল সংগঠন করতে পেরে আমরা সবাইতো খুশিতে আটখানা। আমাদের সফলতায় পাড়ায় আর স্কুলে সবার মুখে মুখে আমাদের নাম। সবাই অন্য রকম দৃষ্টিতে আমাদের দেখতে লাগল।
আমরা যখন প্রেম নিবারন কমিটি নিয়ে ব্যস্ত আছি, মুহিদ ভাইকে দেখলাম কেমন জানি অন্যমনস্ক। সংগঠনকে তেমন একটা সময় দিতে চান না। সংগঠনের ব্যাপারে তাকে বেশ নিরুৎসাহিত দেখা গেল। ইদানিং তার খোঁজ পাওয়া ও কঠিন, কোথায় কোথায় যেন যান। তাছাড়া এখন নাকি কবিতা লেখাও শুরু করেছেন। ওনার ব্যাপার স্যাপার কারো বোধগম্য হল না।
সেদিন কলেজ মাঠে বেড়াতে গিয়ে ব্যাপারটা আমাদের কাছে খোলাসা হয়ে গেল। কলেজের পুকুর ঘাটে বসে ওনাকে এক মেয়ের সাথে আলাপ করতে দেখলাম। ওনি যে ইদানিং প্রেমে পড়েছেন সেটা আর আমাদের বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তু আমরাই প্রেম বিরোধী আন্দোলন করে আমরাই যদি... ... ... । ব্যাপারটা আমি আর ভাবতে পারছি না। সামনে যে মহাবিপদ আছে সেটা অন্তত টের পাচ্ছি। ভয়াবহ ব্যাপার থেকে বাচতে হলে কয়েকদিন গা ঢাকা না দিলেই নয়!


যারা ‘সুড়ঙ্গ বন্দী ‘ উপন্যাসটি পড়েননি তারা  ক্লিক করুন। পুরোটা একসাথে পাবেন।

No comments:

Post a Comment