Monday, September 19, 2011

স্বপ্নের পাখি

                                  
প্রতিদিনই আবিরের মনটা খুব খারাপ থাকে।জীবনটাকে তার কেমন যেন একঘেয়ে মনে হয়। বন্দী পাখি খাচায় বসে যেমন ছট্ফট্ করে তার অবস্থা ঠিক তাই।মাঝে মাঝে তার কাছে নিজেকে যন্ত্রমানব মনে হয়।
প্রতিটা দিন প্রতিটা সময় তাকে নানা রকম ধরা বাধা নিয়মের মধ্যে চলতে হয়।এইতো সকাল ছয়টা না বাজতেই আম্মু এসে তার ঘুম ভেঙ্গে দিয়ে যায়। তারপর সে হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করে বইয়ের বোঝা নিয়ে স্কুলে চলে যায়। তার আব্বু তাকে স্কুলে দিয়ে আসে। তাকে স্কুলে দিয়ে এসে তার বাবা-মা চলে যায় নিজ নিজ অফিসে। আসার সময় বাড়ির চাকরটা তাকে স্কুলে থেকে নিয়ে আসে। তার আম্মু তাকে ফোনে বলে দেয় কখন কি করতে হবে। কখন খেতে হবে আবার কখন হোম ওয়ার্কগুলো করতে হবে ইত্যাদি। স্কুল থেকে এসে তারপর সে ঘরের ভিতর বন্দি। হয়ত টিভি দেখা নয়ত কম্পিউটারে গেমস খেলা ছাড়া তার আর কোন কাজ থাকে না। সারাক্ষণ টিভি দেখা কিংবা গেমস খেলতে কারই বা ভাল লাগে? আবির ঘরে একা বসে থেকে নানা কথা ভাবতে থাকে। সে একটু বাইরে ও যেতে পারে না। কারণ তার মায়ের মানা। মা বলে, বাইরে গেলে তুমি খারাপ হয়ে যাবে, বাইরে যায় যত্তসব বখাটে ছেলেরা। তাই বাইরে না যেতে মায়ের করা নির্দেশ। ঘরে সে কথা বলার মত একজন  মানুষ ও পায় না।
মাঝে মাঝে সে খাঁচায় বন্দি থাকা পাখিটার সাথে এক এক কথা বলতে থাকে। সে নানা কথা বললে ও পাখিটা তার কোন উত্তর দেয় না। শুধু তার দিকে চেয়ে ডাকতে থাকে। একদিন আবির বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাখির খাঁচাটার সামনে একা একা কথা বলছিল। সে তার দুঃখের কথা পাখিটাকে শুনাতে লাগল। এমন সময় সে শুনতে পেল কে যেন বলছে, আবির তুমি দুঃখ করো না, আমি তোমাকে এখান থেকে মুক্ত কওে দিতে পারি। আবির বুঝতে পারল না কে কথা বলছে। সে চারদিক তাকিয়ে আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল না। সে ভাবতে লাগল, কে কথা বলছে? সেই কন্ঠটি আবার বলল; তুমি হয়ত ভাবছ তোমার আশেপাশে কেউ নেই অথচ কে কথা বলছে, তুমি খাঁচার পাখিটির দিকে তাকাও তাহলে বুঝতে পারবে আমি কে কথা বলছি। আবির খাঁচায় তাকিয়ে তো অবাক! তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না যে পাখিটি কথা বলছে! সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, সত্যি তুমি কথা বলতে পার আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। তখন পাখিটি বলল, বিশ্বাস না হওয়ারই কথা, কারণ আমরা কোন দিন মানুষের সাথে কথা বলি না। আমরা তোমাদের মনের কথা ও বুঝতে পারি। আমি জানি তোমার দুঃখ আর আমার দুঃখ এক। আমিও তোমার মত খাঁচায় বন্দি। ইচ্ছা করলে ঘুরে বেড়াতে পারি না। তোমাকে আমার একটা কথা রাখতে হবে, আমি যে কথা বলতে পারি এটা তুমি কাউকে বলবে না। আবির পাখিটির কথায় রাজি হয়ে যায়। তার কাছে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। কারণ সে-ই পাখিটিকে খাচায় বন্দি করে রেখেছে। সে আস্তে করে খাঁচার মুখটি খুলে দেয়। আর তখন পাখিটি খাঁচা থেকে মুক্ত হয়ে যায়। আবিরের পাখিটির প্রথম কথাটি মনে পড়ে। সে বলে আমি তো তোমাকে মুক্ত করে দিয়েছি বন্দি খাঁচা থেকে, এখন বল তুমি কিভাবে আমাকে এই বন্দি জীবন থেকে মুক্ত করবে। তখন পাখিটি বলল, হ্যাঁ আমি তোমাকে বন্দি জীবন থেকে মুক্ত করব। আমি তোমাকে খোলা আকাশ, বন-জঙ্গল সব ঘুরিয়ে আনব। তার জন্য তোমাকে অনেক দিন বাবা-মা থেকে আলাদা থাকতে হবে। তুমি থাকবে দূর বহু দূরে। পৃথিবীর সব দেশ তুমি ঘুরবে। আবিরের প্রথমত পাখিটির কথা বিশ্বাস হয় না। পৃথিবী দেখার সখ তার অনেক দিনের তাই সে পাখিটির কথায় রাজি হয়ে যায়।
পাখিটি খোলা আকাশে এসে তার ডানাগুলো মেলে দেয়। আর তখন সে অদ্ভুদভাবে বড় হতে থাকে। আবির পাখিটির ডানায় চড়ে বসে। পাখিটি তাকে নিয়ে খোলা আকাশে উড়তে থাকে। আবির পাখিটিকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা তুমি এত বড় হলে কিভাবে? পাখিটি কিছ্্ুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আমার বাড়ি দক্ষিন আমেরিকায়। কোন দেশ এখন আর মনে নেই। আমরা ছিলাম অনেক বড় জাতের পাখি। নিজের নামটা ও ভুলে গেছি অনেক দিন বন্দি থেকে। একবার শীতের সময় আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলাম। আমি তখন সদ্য উড়তে পারা একটি পাখি। বাংলাদেশে আসতে আমাদেও বহু বিপদেও সম্মুখীনহতে হয়েছিল। মা বলেছিল, বাংলাদেশ নাকি খুব সুন্দর একটা দেশ তবে এর মানুষগুলো নাকি খুব খারাপ। তারা নাকি অতিথি পাখিদের মেরে ফেলে তাই তিনি আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস শেষ পর্যন্ত আমাকেই ওদের হাতে ধরা পড়তে হয়েছিল। আমাদের একটা নিয়ম ছিল মানুষের হাতে ধরা পড়লেই আমরা ছোট হয়ে যাই। শিকারীরা আমাকে হঠাৎ ছোট হতে দেখে তারা খুব অভাক হয়েছিল। আমাকে নিয়ে তারা নানা রকম গবেষণা করল কিন্তু শেষে তথ্যে কিছুই পাওয়া গেল না। আর তখন তোমার আব্বু আমাকে অনেক টাকা দিয়ে কিনে বাড়ি নিয়ে যায়। তখন থেকে আমি তোমার দুঃখগুলো উপলব্ধি করতে লাগলাম। বুঝলাম আমার মতো তোমার ও একই কষ্ট। আর তুমি আমাকে মুক্ত করে দেওয়ায় আবার আমি আগের মত হয়ে গেছি। পাখিটি কথাগুলো বলার সময় তার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। আবির ও পাখিটির কষ্ট বুঝতে পারল। সে (পাখিটি) আজ প্রায় তিন বছর তার মা-বাবাকে দেখতে পারেনি। সে ছিল তাদেও থেকে অনেক দূরে।
মুহূর্তের মধ্যে পাখিটি তার আগের সব কষ্ট ভূলে গেল। সে নতুন মুক্ত স্বাধীন জীবনকে উপভোগ করতে লাগল। আবিরের আনন্দ যেন আর ধরে না। সে কখনো নদী দেখিনি। শুধু বইয়ের পাতায় নানা বর্ণনার কথা সে শুনেছে। আজ সে নিজের চোখে নদী দেখছে, নৌকা, গাছ-বন দেখছে সত্যিই তার কাছে ব্যাপারটা অন্যরকম লাগছে। বহু সাগর নদী পেরিয়ে তারা চলে এল আমাজান বনে। এ সময় তার (পাখিটির) সাথে দেখা হলো তার পুরনো বন্ধুদের। তারা প্রথমে তাকে চিনতে পারল না। পরে যখন সব ঘটনা শুনল তখন তারা সবাই আনন্দে কেঁদে দেয়। তাদের কাছে সে তার বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, তোমাকে হারিয়ে তারা আর এই দেশে ফিরে আসেনি। আমরা ঠিকই চলে এসেছি। কিন্তু এখনো তারা তোমার অপেক্ষায় বসে আছে। তাদেও কথা শুনে পাখিটি খুব ব্যাকুল হয়ে যায়। সে পুনরায় বাংলাদেশের দিকে ফিরে আসতে লাগল।
এদিকে আবিরকে না পেয়ে তার বাবা হুলস্থ’ূল কান্ড করে বসিয়েছে। তারা পুলিশ, পত্রিকা ,টেলিভিশন সব জায়গায় খবর দিয়ে একাকার করেছে। খুব আদরের সন্তান তাই তাকে না পেয়ে তার বাবা-মার উম্মাদ হওয়ার অবস্থা!
আবির বাইরের পৃথিবী যতই দেখে ততই মুগ্ধ হয়।সে পাখিটা তাকে পৃথিবীর সব দেশ ঘুরিয়েছে। পৃথিবীর সব ভাস্কর্য সে মুগ্ধ হয়ে দেখেছে। সে কখনো ভাবেনি পৃথিবী এত সুন্দর! সে যত দেখে তত মুগ্ধ হয়। আবির নিজেকে সবচে সুখী মানুষ ভাবতে লাগল।
দেখতে দেখতে তারা আবার চলে এল বাংলাদেশে। সেই পাখিটার সাথে তার বাবা-মার দেখা হয়।তারা তাকে দেখে আনন্দে কেঁদে দেয়। অতি আদরে পাখিটাকে তার মা বুকে তোলে নেয়। মায়ের এ ভালবাসা দেখে আবিরেরও তার মায়ের কথা মনে পড়ে।মায়ের মুখটা তার চোখে ভাসতে থাকে।সে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্না করতে থাকে।মা পাখিটা আবিরের কথা জানতে চায়। বাচ্চা পাখিটা আবিরের সব কথা খুলে বলে।আবিরের জন্য মা পাখিটা খুব দুঃখ করে।তবুও তাকে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসার জন্য বলে।সে বলে, যত দুঃখ কষ্ট হোক কোন বাচ্চা তার মায়ের সান্নিধ্য ছাড়া থাকতে পারে না।
 বাচ্চা পাখিটা আবিরকে তার বাসায় দিয়ে যায়।পাখিটাকে বিদায় জানাতে আবিরের খুব কষ্ট হয়। তার চোখ দিয়ে হঠাৎ টুপটুপ করে পানি পড়তে থাকে।
                           *****************************
আবিরকে ফিরে পেয়ে তার বাবা-মা যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। তারা মা তাকে আনন্দে কোলে তোলে নেয়। তখন আবিরের সেই পাখিটার কথা মনে পড়ে।সত্যিই তো, মা ছাড়া কে-ই বা থাকতে পারে। তবে তার বাবা গোয়েন্দার মতো নানা প্রশ্ন করতে থাকে। আবির পাখিটার কথা কিছুই বলে না।সে কোন রকমে কথা কাটিয়ে যায়।
সেদিন থেকে আবিরের মা-বাবা তার কষ্টগুলো বুঝতে পারে। আবিরের আম্মু তার চাকরিটা ছেড়ে দেয়। স্কুলের পর তিনি আবিরকে নিয়ে গল্পের বই কিনতে যায়, নানা জায়গায় ঘুরিয়ে আনে। রাতে পড়া শেষ হলে তাকে নিয়ে বসে বসে গল্প শোনায়।তখন থেকে আবিরের সব শূন্যতা কেটে যায়। তার দিনগুলো কাটে বেশ আনন্দের সাথে। জীবনটাকে তার কাছে আর যান্ত্রিক মনে হয় না। সপ্তাহে একবার তার বাবা তাকে নিয়ে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বেরিয়ে আসে।আবির মনে মনে সেই পাখিটাকে কৃতজ্ঞতা জানায়।
খাঁচার শূন্যতা এতদিন তার বাবা-মার চোখে পড়েনি। কারণ খাঁচাটা তার রুমে থাকায় কেউ অতটা খেয়াল করেনি।  কিন্তু সেদিন বিষয়টা তার মায়ের চোখে আটকে যায়। সে জিজ্ঞাসা করে, পাখিটা কোথায়? আবির নিঃসঙ্কোচে সে দিনের কথা সব খুলে বলে। কিন্তু তার আম্মু কিছুই বিশ্বাস করে না। তবে ওর সামনে ওরটাই বিশ্বাস করেছে এমন ভাব দেখাল। তার আম্মু হয়তো ভেবেছে, পাখিটাকে ছেঁড়ে দিয়ে সে মিথ্যে গল্পের ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে পারল না যে, সে দিনের ঘটনাটা ছিল সত্যি! তবে সে দিনের ঘটনাগুলো আবিরের কাছেও কেমন যেন রূপকথার মতো মনে হয়।
মাঝে মাঝে স্বপ্নেও পাখিটা আবিরের সাথে দেখা করে যায়। তাই আবির পাখিটার নাম দেয় ‘স্বপ্নের পাখি’। সে এখনো মাঝে মাঝে স্বপ্নে পাখিটার সাথে ঘুরে বেড়ায়!

No comments:

Post a Comment